হাদিসের আলোকে খাওয়ার আদব কয়টি - ঘুমের আদব সমূহ

ঘুমের আদব সমূহ, দাঁড়িয়ে পানাহার করা কি হারাম বা মাকরূহ, দাঁড়িয়ে পানি পান করা হাদিস, হাদিসের আলোকে খাওয়ার আদব কয়টি একজন মুসলিম হিসেবে আমাদেরকে এ সকল বিষয় সম্পর্কে জ্ঞান থাকা অত্যন্ত জরুরী। শুধু জানলেই হবে না মানতেও হবে। কেননা আল্লাহ ও আল্লাহর রাসূলের তরিকায় জীবন যাপন করাই ইসলাম। 

হাদিসের আলোকে খাওয়ার আদব কয়টি - ঘুমের আদব সমূহ

একজন মুমিন মালদা তার সবকিছুই করতে চান তার রসুলের আদলে অর্থাৎ রসূলের সুন্নত অনুসারে। একজন মুসলিম হিসাবে আমাদের উচিত রসূলের তরিকা অনুযায়ী জীবন যাপন করা। কিন্তু আমরা কয়জনই বা তা মান্য করি বা মেনে চলি। আজকের এই পোস্টে খাওয়ার আদব এবং ঘুমের আদব সম্পর্কে সংক্ষেপে বর্ণনা করা হয়েছে। আশা করি আপনি এই পোষ্টের মাধ্যমে উপকৃত হবেন।

পোস্ট সূচিপত্রঃ হাদিসের আলোকে খাওয়ার আদব কয়টি - ঘুমের আদব সমূহ

  • ঘুমের আদব সমূহ
  • দাঁড়িয়ে পানাহার করা কি হারাম বা মাকরূহ
  • দাঁড়িয়ে পানি পান করা হাদিস
  • হাদিসের আলোকে খাওয়ার আদব কয়টি

ঘুমের আদব সমূহ

আমার এক নানু বললেন যে, কোল বালিশ নিয়ে ঘুমানো না কি ঠিক না-গুনাহ! বোতল দিয়ে পানি পান করা গুনাহ! কাপড় তিন বার ধোয়া, বিসমিল্লাহ বলা নাকি নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এর সুন্নত? এ কথাগুলো কি সঠিক কথা?

কাপড় ধোয়ার শুরুতে বিসমিল্লাহ বলা সুন্নত-এটা ছাড়া আপনার নানুর অন্যান্য কথাগুলো কেবলই অনুমান নির্ভর। ইসলামী শরীয়তে এ সব কথার নূন্যতম কোন ভিত্তি নাই। যাহোক সঠিক কথা হল, কোল বালিশ নিয়ে ঘুমানো এবং বোতলে পানি খাওয়ায় কোন আপত্তি নাই। তবে ঘুম ও পানি পানের ইসলামী আদব রক্ষা করার চেষ্টা করতে হবে।

হাদিসের মধ্যে ঘুমানোর কিছু আদব বা সুন্নত বর্ণনা করা হয়েছে। সেগুলো হচ্ছে-

  1. ঘুমের পূর্বে ওযু করা।
  2. বিছানায় শোয়ার পূর্বে লুঙ্গি বা পরিধেয় বস্ত্রের নিম্নাংশ অথবা অন্য কোন কাপড় দ্বারা বিছানা ঝেড়ে নেয়া।
  3. ঘুমের পূর্বে যে সকল আমল, জিকির ও তাসবীহ রয়েছে সেগুলো পড়া। তারপর ঘুমের দুআ পড়ে ঘুমানো।
  4. ডান দিকে কাঁথ হয়ে শোয়া সুন্নত। পেটের উপর ভর করে উপুড় হয়ে বা বাম দিকে কাঁথ হয়ে ঘুমানো ঠিক নয়। তবে উপুড় হয়ে শয়ন করা বেশি খারাপ বাম দিকে কাঁথ হয়ে শয়ন করার চেয়ে। কারণ, হাদিসে উপুড় হয়ে শয়ন করাকে জাহান্নামীদের শয়ন পদ্ধতি হিসেবে উল্লেখিত হয়েছে। তবে ইচ্ছে করলে কখনও কখনো চিৎ হয়ে শয়ন করা জায়েজ আছে।
কাপড় ধোয়ার শুরুতে বিসমিল্লাহ বলা

কাপড় ধেয়ার পূর্বে তিনবার নয় ১ বার বিসমিল্লাহ বলাই যথেষ্ট। কেবল কাপড় ধোয়া নয় বরং যে কোন কাজের শুরুতে একবার বিসমিল্লাহ বলা সুন্নত। এতে বান্দার প্রতি আল্লাহর রহমত ও বরকত নেমে আসে এবং তিনি তাকে সাহায্য করেন। আল্লাহু আলাম। (উত্তর প্রদানেঃ আব্দুল্লাহিল হাদী বিন আব্দুল জলীল মাদানি)

দাঁড়িয়ে পানাহার করা কি হারাম বা মাকরূহ

দাঁড়িয়ে খাওয়া বা পান করা জায়েজ তবে বসে করা উত্তম। অনেকে মনে করে, দাঁড়িয়ে খাওয়া বা পান করা হারাম (নিষেধ) অথবা মকরুহ (অ পছন্দনীয়)। এ ধারণা ঠিক নয়। নিন্মে এ বিষয়ে কতিপয় হাদীস, সেগুলোর সংক্ষিপ্ত পর্যালোচনা এবং আলেমদের বক্তব্য তুলে ধরা হল-

দাঁড়িয়ে পানাহার করা জায়েজ। এটিকে মাকরূহ বলা ঠিক নয়। দলিল নিন্মোক্ত হাদিসগুলো-

১. আলি রা. হতে বর্ণিত। তিনি দাঁড়িয়ে পান করলেন। অত:পর বললেন,

إِنَّ نَاسًا يَكْرَهُ أَحَدُهُمْ أَنْ يَشْرَبَ وَهُوَ قَائِمٌ ، وَإِنِّي رَأَيْتُ النَّبِيَّ صَلَّى اللَّهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ فَعَلَ كَمَا رَأَيْتُمُونِي فَعَلْتُ

"কিছু মানুষ দাঁড়িয়ে পান করাকে অপছন্দ করে। কিন্তু আমি নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামকে ঠিক এইভাবে পান করতে দেখেছি, যেভাবে তোমরা আমাকে পান করতে দেখলে।” [সহিহুল বুখারি: ৫৬১৫]

২. মুসনাদে আহমদে আলি রা. হতে বর্ণিত হয়েছে যে, তিনি দাঁড়িয়ে পানি পান করলেনঃ

فَنَظَرَ إِلَيْهِ النَّاسُ كَأَنَّهُمْ أَنْكَرُوهُ فَقَالَ : مَا تَنْظُرُونَ ! إِنْ أَشْرَبْ قَائِمًا فَقَدْ رَأَيْتُ النَّبِيَّ صَلَّى اللَّهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ يَشْرَبُ قَائِمًا ، وَإِنْ أَشْرَبْ قَاعِدًا فَقَدْ رَأَيْتُ النَّبِيَّ صَلَّى اللَّهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ يَشْرَبُ قَاعِدًا

“তখন কিছু মানুষ তাঁর দিকে এমনভাবে তাকাল যে, বুঝা গেল, তারা যেন এটাকে গর্হিত কাজ মনে করে। তখন তিনি বললেন, তোমরা কী দেখছ? আমি যদি দাঁড়িয়ে পান করি তাহলে (জেনে রাখো যে,) আমি নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামকে দাঁড়িয়ে পান করতে দেখেছি আর আমি যদি বসে পান করি তাহলেও (জেনে রাখ) যে, আমি নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামকে বসে পান করতে দেখেছি।” [মুসনাদ আহমদ, হা/৭৯৭, আহমদ শাকের তাহকীক মুসনাদ আহমদে বলেন, এর সনদ সহীহ]

৩. আব্দুল্লাহ ইবনে উমর রা. থেকে বর্ণিত। তিনি বলেন,

كُنَّا نَأْكُلُ عَلَى عَهْدِ رَسُولِ اللَّهِ صَلَّى اللَّهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ وَنَحْنُ نَمْشِي ، وَنَشْرَبُ وَنَحْنُ قِيَامٌ

“রাসুলুল্লাহ রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এর যুগে আমরা চলতে চলতে আহার করতাম এবং দাঁড়িয়ে পান করতাম।" [সুনান তিরমিযী, হাদিস নাম্বার ১৮৮১, সহীহ-আলবানি]

এ সব হাদিস থেকে বুঝা যায় যে,রাসুলুল্লাহ রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ও তাঁর সাহাবীগণ দাঁড়িয়ে ও হাঁটা অবস্থায় পানাহার করতেন। সুতরাং এটি জায়েয হওয়ার ব্যাপারে কোন সন্দেহ রইল না।

দাঁড়িয়ে পানি পান করা হাদিস

কিছু হাদিসে দাঁড়িয়ে পান করা ব্যাপারে নিষেধাজ্ঞা এসেছে। যেমন আনাস রা. থেকে বর্ণিত, নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম লোকদেরকে দাঁড়িয়ে পান করতে নিষেধ করেছেন। [মুসলিম ২০২৪, তিরমিযী ১৮৭৯, আবু দাউদ ৩৭১৭, ইবনে মাজাহ ৩৪২৩, আহমদ ১১৭৭৫]

এই হাদিসে রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম দাঁড়িয়ে পান করতে নিষেধ করেছেন। এ মর্মে আরও কিছু হাদিস বর্ণিত হয়েছে। দাঁড়িয়ে পান করার নিষেধাজ্ঞা এবং বৈধতার হাদিসের মাঝে সমন্বয়-
এই হাদিসগুলোর সমন্বয় সাধান করতে গিয়ে ইমাম নববী রহ. বলেন, “বসে পানাহার করা উত্তম ও পূর্ণাঙ্গ কিন্তু দাঁড়িয়ে পানাহার করা জায়েজ। 

দাঁড়িয়ে খাওয়া পান করাকে মাকরূহ বলা ঠিক নয়। কারণ রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম নিজে এবং তাঁর সম্মানিত সাহাবিগণ দাঁড়িয়ে ও চলা অবস্থায় পানাহার করেছেন। সুতরাং তারা যে কাজ করেছেন সেটাকে মাকরূহ বা অ পছন্দনীয় বলা মোটেই ঠিক হবে না।”

দাঁড়িয়ে পান করলে বমি করে ফেলে দেওয়ার নির্দেশ সংক্রান্ত হাদিসটি রহিত, সৌদি আবরের সাবেক গ্র্যান্ড মুফতি আল্লামা আব্দুল আজিজ বিন বায রাহ. বলেন,

الشرب قاعدًا أفضل، والشرب قائمًا لا بأس به، والحديث الذي فيه الاستقاء منسوخ؛ لأن الأحاديث الصحيحة دلت على أنه ﷺ كان يشرب قائمًا وقاعدًا، من حديث ابن عباس، ومن حديث علي رضي الله عنه فلا بأس أن يشرب قاعدًا وقائمًا، والقعود أفضل، أما: فليستقيء

"বসে পান করা উত্তম। দাঁড়িয়ে পান করায় কোনও অসুবিধা নেই। আর যে হাদিসে বমি করার কথা এসেছে তা মানসুখ (রহিত)। কারণ ইবনে আব্বাস রা. ও আলি রা থেকে একাধিক সহিহ হাদিস দ্বারা প্রমাণিত হয়েছে যে, নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম দাঁড়িয়ে ও বসে পানি পান করেছেন।

সুতরাং দাঁড়িয়ে ও বসে পান করতে কোনও অসুবিধা নেই। বসা উত্তম। আর যে হাদিসে বলা হয়েছে যে, فليستقيء (যেন বমি করে দেয়)তা রহিত।” আল্লাহু আলাম। (উত্তর প্রদানেঃ শাইখ আবদুল্লাহিল হাদী বিন আবদুল জলীল)

হাদিসের আলোকে খাওয়ার আদব কয়টি

হাদিসের আলোকে খাওয়ার অনেকগুলো আদব রয়েছে। তার মধ্যে বিশেষ বিশেষ যে আদবগুলো রয়েছে সেগুলো নিজে বিস্তারিত বর্ণনা করা হলো-

  • পানাহারের শুরুতে বিসমিল্লাহ পাঠ করা
  • পানাহার করার প্রথমে বিসমিল্লাহ বলতে ভুলে গেলে মাঝখানে যখনই স্মরণ হবে তখনই বলবে, “বিসমিল্লাহি আওওয়ালাহু ওয়া আখিরাহু।”
  • পানাহার করার পর আল হামদুলিল্লাহ অথবা খাওয়া শেষের দুআ পাঠ করা বলা সুন্নত।
  • ডান হাতে পানাহার করা সুন্নত। বাম হাতে পানাহার করা হারাম এবং শয়তানের কাজ।
  • পান করার জন্য গ্লাস বা বোতল যাই হোক না তিন ঢোকে পান করা ভালো। তবে প্রয়োজনবোধে এক বা দু ঢোকে পান করাও জায়েজ।
  • পানি পান করার সময় গ্লাস বা পানপাত্রে নি:শ্বাস ফেলা ঠিক নয়।
  • হেলান দিয়ে পানাহার করা ঠিক নয়।
  • বসে পানাহার করা উত্তম। কিন্তু প্রয়োজনবোধে দাঁড়িয়ে বা পথ চলতে চলতে পানাহার করায় কোন আপত্তি নেই। (এ বিষয়ে বিস্তারিত আলোচনা ইতোপূর্বে করা হয়েছে)
  • খাবার নিচে পড়ে গেলে সম্ভব হলে তা পরিষ্কার করে খাওয়া।
  • খাবার প্লেট ও আঙ্গুল পরিষ্কার করে খাওয়া।
  • খাদ্য-পানীয় অপচয় না করা।
  • এক প্লেটে কয়েকজন একসাথে বসে খাওয়া তৃপ্তি অর্জন ও বরকতের কারণ।
  • একসাথে খেতে বসলে নিজের দিক থেকে নিয়ে খাওয়া। হাত বাড়িয়ে অন্যের দিক থেকে তার অনুমতি ছাড়া খাওয়া ঠিক নয়।
  • বেশি গরম অবস্থায় খাওয়া বরকত চলে যাওয়ার কারণ।
  • স্বর্ণ-রৌপ্যের পাত্রে পান করা ঠিক নয়।
  • একসাথে একাধিক ব্যক্তি উপস্থিত থাকলে বড় ও সম্মানিত ব্যক্তির আগে খাওয়া শুরু না করা।
  • মেহমান হিসেবে খেতে গেলে খাওয়ার পর মেহমানের জন্য হাদিসে বর্ণিত দুআ পাঠ করা এবং খাওয়া শেষে যথাসম্ভব সেখানে দেরি না করা। অবশ্য মেজবানের পক্ষ থেকে থাকার সম্মতি থাকলে তাতে সমস্যা নেই ইত্যাদি।
সবশেষে বলা যায় যে রসুলের সুন্নত মেনে চললেই আমাদের খাওয়ার আদব এবং ঘুমানোর আদব সবগুলোই মান্য করা হয়ে যাবে। আর একজন মুসলিম হিসেবে অবশ্যই আমাদেরকে এগুলো মেনে চলা কর্তব্য। আল্লাহ সবাইকে আমল করার তৌফিক এনায়েত করুন, আমিন। 

এই পোস্টটি পরিচিতদের সাথে শেয়ার করুন

পূর্বের পোস্ট দেখুন পরবর্তী পোস্ট দেখুন
এই পোস্টে এখনো কেউ মন্তব্য করে নি
মন্তব্য করতে এখানে ক্লিক করুন

SM TECHY এর নীতিমালা মেনে কমেন্ট করুন। প্রতিটি কমেন্ট রিভিউ করা হয়।

comment url