বর্ষাকাল রচনা ক্লাস ৩, ৪, ৫, ৬, ৭, ৮, ৯, ১০

গ্রীষ্মকালের পরেই আসে বর্ষাকাল। বাংলাদেশের ষড়ঋতুর মধ্যে বর্ষাকাল একটি অন্যতম ঋতু। সকল ক্লাসের শিক্ষার্থীদের কথা বিবেচনা করে, বর্ষাকাল সম্পর্কে নিচে দুইটি রচনা বর্ণনা করা হয়েছে। দুটি রচনার মধ্যে একটি ছোট রচনা আরেকটি বড় রচনা। ছোট রচনাটি ছোট ক্লাসের ছাত্র-ছাত্রীদের জন্য এবং বড় রচনাটি মাধ্যমিক পড়ুয়া ছাত্রছাত্রীদের জন্য। আপনি চাইলে দুইটাই পড়তে পারেন। 

বর্ষাকাল রচনা ক্লাস ৩, ৪, ৫, ৬, ৭, ৮, ৯, ১০

বর্ষাকাল রচনা ক্লাস ৩, ৪, ৫, ৬, ৭, ৮, ৯, ১০

আষাঢ়-শ্রাবণ দুই মাস বর্ষাকাল। গ্রীষ্মের দাবদাহ শেষে প্রকৃতির বুকে অপরূপ বর্ষার আগমন ঘটে। এ ঋতুর প্রধান বৈশিষ্ট্য সজল মেঘে খেলা আকাশ, কর্দমাক্তপীঠ-ঘাট নদ-নদী, খাল-বিল, পুকুর-ডোবা কানায় কানায় পূর্ণ, গাছপালাএ ঋতুর প্রধান বৈশিষ্ট্য সজল মেঘে আশপাসে মৌসুমি বায়ুর উপস্থিতি বেশি থাকার কারণে বৃষ্টিপাত বেশি হয়ে থাকে। মৌসুমি বায়ুর আগমনে জ্যৈষ্ঠের ও মোটা দিন। 

বর্ষাকালে কেটে গিয়ে প্রশান্তির একটা হাওয়া বয়ে যায়। আষাঢ়-শ্রাবণে বর্ষার অঝোর বর্ষণ গোটা পরিবেশটাকেই প্রাণবন্ত করে তোমর ভাবটা অকাশে ভেসে বেড়ায় সাদা-কালো মেঘ। কখনো বৃষ্টি, কখনো মেঘ, কখনো রৌদ্র। ষড়ঋতুর অন্যতম বর্ষা ঋতু যা বাংলাদেশের আবহাওয়া, পরিবেশ, আর মানুষের মনোজগতকে বদলে দেয়। 

অঝোর ধারায় বৃষ্টিস্নাত হয় ধরিত্রী, রোদে ঝলসে যাওয়া গাছপালা হয়ে এক সবুজ প্রাণবন্ত। বর্ষার বৃষ্টির ধ্বনি আমাদের পঞ্চইন্দ্রিয়কে অভিভূত করে। এ কারণে এ দেশের কবি-সাহিত্যিক বর্ষাকে নিয়েই অধিক সাহিত্য রচনা করেছেন। বর্ষার সুশীতল বর্ষণ প্রকৃতির সকল চাওয়া পাওয়াকে তৃপ্ত করে। ছোটো বড়ো সরোবর, ডোবা-নালায় হস্র শাপলা শালুকের সমারোেহ চোখে পড়ে। 

কদম, কেয়ার স্নিগ্ধ হাসি কবি মনকে উদাসীন করে তোলে। বর্ষার আগমনে খাল-বিল সব তলিয়ে পানিতে কানায় কানায় পরিপূর্ণ হয়ে যায়। নদীগুলোর দুইপাড় পানিতে ভেসে যায়। বর্ষার অতি বৃষ্টিতে অনেক সময় বন্যাও দেখা যায়। বন্যাতে অনেক সময়ই আমাদের দেশের অধিকাংশ এলাকা পানিতে তলিয়ে যায়। গ্রামীণ জনপদ বর্ষার পানিতে টইটম্বুর হয়ে ওঠে, বাড়িগুলো বিচ্ছিন্ন দ্বীপে পরিণত হয়। 

বর্ষা আমাদের প্রকৃতিকে যেমন ফলে ফসলে ভরিয়ে দেয় তেমনই আমাদের মনকেও স্পর্শ করে। গুরুগুরু মেঘের ডাকে ধানখেতে বিচরণ করে কই, শিং আরও কতো ছোটো আকৃতি ও প্রকৃতির মাছ। কদম বর্ষার প্রতীক। এ সময় বাতাসে ভেসে আসে কদম ফুলের গন্ধ। বর্ষায় আমন ধানসহ অন্যান্য ধান আর অর্থকরী ফসল পাটের খুব ভালো আবাদ হয়। বর্ষায় জমিতে পলি পড়ে জমির উর্বরতা শক্তি বৃদ্ধি করে। বর্ষা প্রকৃতিকে ধুয়ে মুছে পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন করে দিয়ে যায়। বর্ষা যেমন আনন্দ বয়ে আনে তেমনই কখনো কখনো দুঃখ, কষ্টের কারণ হয়ে দাঁড়ায়।

বর্ষাকাল রচনা

সূচনা: 'বর্ষামঙ্গল' কবিতায় রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর বর্ষা বন্দনা করতে গিয়ে বলেছেন, ওই আসে ওই অতি ভৈরব হডষে জলসিঞ্চিত ক্ষিতিসৌরভরভসে ঘনগৌরবে নবযৌবনা বরষা শ্যামগম্ভীর সরসা।

ভৈরব হরষে' এবং 'শ্যামগঞ্জীর সরসা'- দুটি কথা দ্বারা বর্ষার প্রচণ্ডতা এবং মধুরতা উভয় বৈশিষ্ট্য বোঝা যায়। সত্যই তাই। বাংলাদেশে বর্ষা আসে সাড়ম্বরে- গুরুগম্ভীররূপে। বর্ষার এ আগমন বাংলার প্রকৃতি ও মানুষের মনে সাড়া জাগায়। প্রকৃতিতে আসে এক অভাবিত পরিবর্তন। মানুষের কাছে বর্ষা আশা এবং আনন্দের ঋতু। বর্ষা যুগপৎ আনন্দ-বেদনার ঋতু। বর্ষার আকাশে পুঞ্জীভূত কালো মেঘ দেখে এদেশের কৃষক প্রাণে নব উদ্যম খুঁজে পায়। বর্ষার বৃষ্টি কৃষকদের কাছে বহন করে আনে আশা ও আনন্দের বার্তা।

বর্ষার চেনা রূপ: আকাশে স্নিগ্ধ কালো মেঘের আনাগোনা, বিদ্যুৎ-চমক, গুডুম গুড়ুম আওয়াজ, থেমে থেমে বৃষ্টি, কখনো মুষলধারে, কখনো হালকা তালে আবার কখনো ইলশেগুঁড়ি- এই হলো বর্ষার অনন্য রূপ। মাঝে মাঝে দুতিন দিন সূর্যের মুখ দেখা যায় নাঃ চারদিকে হালকা অন্ধকার বিরাজ করে। আকাশ যেন মুখভার করে থাকে। 

কখনো বৃষ্টির মাঝে বাজ পড়ার বিকট শব্দে ছেলে-বুড়ো সবাই আঁতকে ওঠে। একান্ত প্রয়োজন ছাড়া কেউ সহজে ঘরের বাইরে যেতে চায় না। কবিগুরুর কবিতায় এ আহ্বান এভাবে ধ্বনিত হয়েছে- নীল নর ঘনে আষাঢ় গগনে তিল ঠাঁই আর নাহি রে ওগো আজ তোরা যাসনে ঘরের বাহিরে।

গ্রাম্য-প্রকৃতি: কৃষক আর কৃষির দেশ আমাদের বাংলাদেশ। কৃষি নির্ভর করে বারিবর্ষণের ওপর। বর্ষায় শুষ্ক খাল-বিল এবং নদী-নালা কানায় কানায় ভরে য়ায় এবং মরুপ্রায় প্রান্তরগুলো নতুন শ্যামল তৃণে, শস্যে ও ফলে-ফুলে ভরে ওঠে। মাঠে মাঠে চলে জলের খেলা। বর্ষার বর্ষণে বাংলাদেশ সজীব, প্রাণবন্ত, সতেজ ও ঋদ্ধ হয়ে ওঠে। সর্বত্রই একটা প্রাণ-প্রাচুর্যের পরিচয় প্রকাশ পায়। ছোটো ছোটো নৌকা ঢেউয়ের তালে নাচতে নাচতে চলতে থাকে। ধানের গাছগুলো জলের পরশে শ্যামল হয়ে মৃদু বাতাসে আন্দোলিত হতে থাকে। আশার আনন্দে আন্দোলিত হয় কৃষকের মন।

মানবহৃদয় ও বর্ষা-প্রকৃতি: বর্ষার মাসে মানুষের হৃদয়ের এক গভীর সখ্যের পরিচয় পাওয়া যায়। বর্ষা প্রকৃতি মানুষের মনে এক সহজ- সরল ও স্বচ্ছ অভিব্যক্তির প্রকাশ ঘটায়। কবিচিত্তে বর্ষা আরও প্রভাব ফেলে। বর্ষাকে নিয়ে বাংলা সাহিত্যে অসংখ্য কবিতা রচিত হয়েছে। মহাকবি কালিদাস বর্ষাকালীন প্রেমাতুর মানব হৃদয়ের যে অনিন্দ্যসুন্দর বহিঃপ্রকাশ' তাঁর 'মেঘদূত' কাব্যে ফুটিয়ে তুলেছেন তা বিশ্বসাহিত্যে এক অনবদ্য সৃষ্টি।

উপকারিতা: বর্ষা ধরণির আবর্জনা দূরীভূত করে, দূষিত বায়ু বিশুদ্ধ করে। বর্ষাই বাংলাদেশকে সুজলা-সুফলা ও শস্য-শ্যামলা করেছে। বর্ষার ওপর নির্ভর করে বাঙালিদের আশা-আকাঙ্ক্ষা ও স্বপ্নের বাস্তবায়ন। বর্ষার জলধারা জমিতে পলি টেনে ভূমিকে উর্বর করে। এ সময়ে নৌকাপথে যাতায়াতের ও বাণিজ্যদ্রব্য চলাচলের খুব সুবিধা হয়। বর্ষাকালে কদম, কেয়া, কামিনী, জুঁই, টগর, বেলি প্রভৃতি ফুলের সুগন্ধে চারদিক আমোদিত হয়ে ওঠে। কৃষকের ঘরে আসে অর্থকরী ফসল পাট। বর্ষাকালে প্রচুর মাছ পাওয়া যায়।

অপকারিতা: বর্ষার সুবিধা ও অসুবিধা দুই দিকই আছে। এ সময় বৃষ্টিপাতের ফলে গ্রামের রাস্তাঘাট পিচ্ছিল কর্দমাক্ত হয়ে যায়। মাঝে মাঝে অতি বর্ষণে ফসলাদি নষ্ট হয়ে দুর্ভিক্ষ দেখা দেয়। অপ্রত্যাশিত প্রবল বন্যায় দেশ ভাসিয়ে মানুষকে গৃহহারা করে। বন্যা-পরবর্তী সময়ে ডায়রিয়া, আমাশয় প্রভৃতি পানিবাহিত রোগের ব্যাপক প্রকোপ পড়ে। গবাদি পশুও নানা রোগে পড়ে এবং তাদের প্রচণ্ড খাদ্যাভাব দেখা যায়। এ সময় ভাবা নালায় জল জমে মশকের উৎপত্তি হয়, ফলে ম্যালেরিয়ার উপদ্রব বাড়ে। তবু বর্ষা বাঙালিদের অতি প্রিয়।

বর্ষণমুখর দিন: সত্যিই আজ বাইরে যাবার জো নেই। ঘরে বসেই সমস্ত দিনটা কাটাতে হবে। বেলা বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে বৃষ্টির ধারাও বেড়েই চলছে, থামার কোনো নাম নেই। ঝঝম্ করে অজস্র ধারায় বৃষ্টি ঝরছে। কিন্তু এমন দিনে একা ঘরে বসে দিন কাটানো আমার গক্ষে সম্ভব নয়। ঘুমও আসছে না। সকাল থেকে পড়ার টেবিলে বসে থেকে পড়তে আর ভালো লাগছে না। 

পড়ার রুচি বদলাতে বইয়ের আলমারি থেকে বেছে বেছে কয়েকটি গল্পের বই নিয়ে বিছানায় শুয়ে পড়ে পড়তে শুরু করলাম। কিন্তু কোনোভাবেই বইয়ের পৃষ্ঠায় মনকে আবদ্ধ করতে পারলাম না। আমার দৃষ্টি কেবলই বৃষ্টির দিকে টানছে। ধীরে ধীরে বারান্দায় জানালার পাশে এসে দাঁড়ালাম। বাইরে তাকিয়ে দেখি গাছপালাগুলো জবুথবু হয়ে দাঁড়িয়ে আছে। 

মাঝে মধ্যে বাদলা হাওয়া দমকা দোলা দিয়ে যাচ্ছে। গোরুগুলো গোয়ালে শুয়ে শুয়ে জাবর কাটছে। অন্যান্য পশু-পাখি এখানে-সেখানে জড়সড়ো হয়ে বসে আছে। বৃষ্টির ছাটে দিগন্তে কুয়াশার সৃষ্টি করছে। মনে হলো কর্মমুখর এই জগৎ সংসারের সবাই যেন হাত গুটিয়ে বসে আছে, অথবা মায়া নিদ্রায় ঘুমিয়ে গেছে, কিংবা আমার মতো নিঃশব্দে জানালার পাশে বসে প্রকৃতি কন্যার স্নান দেখছে।

মনের ওপর দিনটির প্রভাব: বৃষ্টি পড়ছে কখনো রিমঝিম, কখনো ঝঝুম্। এমন বাদল দিনের রূপ-রস-শব্দ-গন্ধ আমার সমস্ত মন-প্রাণ আচ্ছন্ন করে রেখেছে। বৃষ্টির একটানা সুর আমাকে অন্যমনষ্ক করে তুলছে। মনের ভেতর নানারকম ভাবনা ঢেউ খেলিয়ে যাচ্ছে। সে ভাব ভাষায় ফুটিয়ে তোলা দুঃসাধ্য। 

সে অনুভূতির কোনো রূপ নেই, নেই নির্দিষ্ট কোনো নাম। কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর তাই লিখেছেন -একলা বসে ঘরের কোণে, কী ভাবি যে আপন মনে সজল হাওয়া যূথীর বনে কী কথা যায় কয়ে।

দিনটির শেষ প্রতিকৃতি: দিনভর বৃষ্টির বিরামহীন ধারায় কখন যে সকাল গড়িয়ে দুপুর, দুপুর গড়িয়ে বিকেল এবং বিকেল মাড়িয়ে সন্ধ্যা ঘনিয়ে এলো তা টের পাওয়ার কোনো অবকাশই ছিল না। বৃষ্টির শব্দ, মেঘের গুরুগুরু গর্জন, গাছের ডালে ডালে বাতাসের ঝাপটা শুনতে শুনতে বর্ষণমুখর দিনটি কেটে গেল। বর্ষণমুখর সন্ধ্যায় আমার মন আরও বেশি উদাস হয়ে এলো। 

মনে পড়ে গেল কবিগুরুর কবিতা- আষাঢ় সন্ধ্যা ঘনিয়ে এল, গেল রে দিন বয়ে বাঁধন হারা বৃষ্টিধারা ঝরছে রয়ে রয়ে।

উপসংহার: বর্ষা মানুষের হৃদয়কে প্রবলভাবে আন্দোলিত করে। কিছু অসুবিধা থাকলেও সুজলা-সুফলা, শস্য-শ্যামলা বাংলা বর্ষারই দান। মেঘের গম্ভীর নাদ, আকাশে বিজলির চিরচঞ্চল লীলা, আর বর্ষার ধারাপতনের শব্দে কার মন না জেগে ওঠে? এমন দিনে প্রাণ যেন কার নিবিড় সান্নিধ্যলাভ করতে চায়। তাই কবিগুরু লিখেছেন- এমন দিনে তারে বলা যায় এমন ঘনঘোর বরিষায়।

এই পোস্টটি পরিচিতদের সাথে শেয়ার করুন

পূর্বের পোস্ট দেখুন পরবর্তী পোস্ট দেখুন
এই পোস্টে এখনো কেউ মন্তব্য করে নি
মন্তব্য করতে এখানে ক্লিক করুন

SM TECHY এর নীতিমালা মেনে কমেন্ট করুন। প্রতিটি কমেন্ট রিভিউ করা হয়।

comment url