মৌলিক গণতন্ত্র কি - মৌলিক গণতন্ত্রের বৈশিষ্ট্য গুলো কি

মৌলিক গণতন্ত্র কি, মৌলিক গণতন্ত্র বলতে কী বোঝায়, মৌলিক গণতন্ত্রের বৈশিষ্ট্য গুলো কি, মৌলিক গণতন্ত্র কে চালু করেন, মৌলিক গণতন্ত্রের স্তর কয়টি, মৌলিক গণতন্ত্রের উদ্দেশ্য, মৌলিক গণতন্ত্রের কাঠামো কিরূপ ছিল এসব কিছু বিষয়েই বিস্তারিত ভাবে বর্ণনা করা হয়েছে। সম্পূর্ণটি মনোযোগ সহকারে পড়ুন তাহলে সঠিক ধারনাটি পাবেন।

মৌলিক গণতন্ত্র কি - মৌলিক গণতন্ত্র বলতে কী বোঝায়


মৌলিক গণতন্ত্র কি - মৌলিক গণতন্ত্রের বৈশিষ্ট্য গুলো কি

ভূমিকা: সভ্যতার ঊষালগ্ন থেকে আজ অবধি সমাজবিবর্তনের ধারায় সাম্যবাদী সমাজব্যবস্থা সামন্তবাদী সমাজব্যবস্থার পালাবদল হয়ে আজ গণতান্ত্রিক সমাজকেই মানুষ শ্রেষ্ঠ রাষ্ট্র ও শাসনব্যবস্থা হিসেবে বিবেচনা করছে। গ্রিক নগররাষ্ট্রে প্লেটো, এরিস্টটলের পক্ষপাত ছিল অভিজাততন্ত্রের প্রতি।

সামন্তপ্রথা বাংলার মাটিকে আঁকড়ে থেকেছে বহু দিন। কিন্তু ইউরোপীয় রেনেসাঁ ও শিল্প বিপ্লবের পর ব্যক্তি নিজেকে নিয়ে বেশি সচেতন হয়ে পড়ে। তার মধ্যে ধীরে ধীরে জাগ্রত হয় গণতান্ত্রিক মূল্যবোধের। ব্যক্তিস্বাতন্ত্র্যের এ আধুনিক যুগে গণতন্ত্র হচ্ছে রাষ্ট্র পরিচালনার জন্য আধুনিক ও সর্বাপেক্ষা গ্রহণযোগ্য পদ্ধতি মানবিক মূল্যবোধ ও ব্যক্তিক অধিকার নিশ্চিত করে গণতন্ত্র।

গণতন্ত্রের সংজ্ঞার সন্ধান: গণতন্ত্রকে বা গণতান্ত্রিক শাসনব্যবস্থাকে সংক্ষেপে সংজ্ঞায়িত করা বেশ কঠিন। সাধারণ অমে গণতন্ত্র অর্থ জনগণের শাসনব্যবস্থা। 'Democracy' শব্দটি দুটি গ্রিক শব্দ থেকে এসেছে। 'Demos' এবং 'Kratos', যা- অর্থ হচ্ছে যথাক্রমে জনগণ ও ক্ষমতা। আধুনিক গণতন্ত্রকে এক কথায় "Government by the people" বলে দেখা যায় ন আধুনিক গণতান্ত্রিক পদ্ধতি প্রতিনিধিত্বমূলক পদ্ধতি। 

এ শাসনব্যবস্থায় জনগণ পরোক্ষভাবে অর্থাৎ তাদের নির্বাচিত প্রতিনিধি মাধ্যমে অংশগ্রহণ করে। রাষ্ট্রবিজ্ঞানী Maciver বলেন, "Democracy is not a way of Governing, Whether bmajority or otherwise, but primarily a way of determining who shall govern and broadly to what end. নির্বাচন এবং জনগণের দ্বারা নির্বাচন গণতন্ত্রের জন্য সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। তবে শুধু নির্বাচনই একমাত্র মুখ্য বিষয় নয়, নির্বাচনের মাধ্যমে এমন একটি সরকার প্রতিষ্ঠা করতে হবে, যেখানে জনগণের অধিকার নিশ্চিত হয়। 

হেরোডোটাসের মতে: প্রায় আড়াই হাজার বছর আগে হেরোডোটাস গণতন্ত্র সম্পর্কে যে অভিমত প্রকাশ করেছেন, তার বঙ্গানুবাদ করলে দাঁড়ায়- 'গণতন্ত্র এমন এক শাসনব্যবস্থা, যেখানে শাসনক্ষমতা আইনত সমাজের সকল সদস্যের হাতে নাস্ত থাকে। আব্রাহাম লিঙ্কনের মতে: গণতন্ত্রের সবচেয়ে গ্রহণযোগ্য সংজ্ঞা দিয়েছেন আব্রাহাম লিঙ্কন। তাঁর মতে, 'জনগণের জন্য, জনগণের দ্বারা পরিচালিত, জনগণের যে সরকার, তাই গণতন্ত্র।' শাসনব্যবস্থা হিসেবে স্বীকৃত। 

মৌলিক গণতন্ত্রের বৈশিষ্ট্য: আধুনিক বিশ্বে গণতন্ত্র এখনো পর্যন্ত শ্রেষ্ঠ রাজনৈতিক জনগণ প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে শাসনব্যবস্থায় অংশগ্রহণ করতে পারে। ব্যাপক অর্থে রাষ্ট্রবিজ্ঞানে 'গণতন্ত্র' শব্দটিকে দুটি বিশেষ ভাবধারায় প্রকাশ করা হয়। প্রথম ভাবধারা অনুযায়ী গণতন্ত্র বলতে একটি বিশেষ ধরনের সরকারকেই বোঝায়, যাতে জনগণ বা বহু ব্যক্তি দেশে রাজনৈতিক ক্ষমতা নিয়ন্ত্রণ করে। দ্বিতীয় ভাবধারা অনুসারে গণতন্ত্র হলো সামাজিক, রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক সাম্যের আদর্শের ভিত্তির ওপর প্রতিষ্ঠিত। গণতন্ত্রই রাষ্ট্র পরিচালনার সর্বাধিক গ্রহণযোগ্য এবং জনপ্রিয় পদ্ধতি।

গণতন্ত্রের ধরন: বিভিন্ন দেশে নানা ধরনের গণতন্ত্র প্রচলিত আছে। গণতন্ত্রের মাধ্যমে জনগণ কীভাবে রাষ্ট্র পরিচালনায় অংশগ্রহণ করছে, সেই দৃষ্টিকোণ থেকে গণতন্ত্র প্রধানত দুধরনের। যেমন: প্রত্যক্ষ গণতন্ত্র ও পরোক্ষ গণতন্ত্র।

প্রত্যক্ষ গণতন্ত্র: যে ব্যবস্থায় জনগণ প্রত্যক্ষভাবে শাসন পরিচালনায় অংশগ্রহণ করে, তাকে বলা হয় প্রত্যক্ষ গণতন্ত্র। এ ব্যবস্থায় জনগণের সরাসরি অংশগ্রহণে রাষ্ট্র পরিচালিত হয়।

পরোক্ষ গণতন্ত্র: যে ব্যবস্থায় জনগণ প্রতিনিধি নির্বাচন করে এবং তাদের নির্বাচিত প্রতিনিধিরাই শাসনকাজ পরিচালনা করেন, তাকে বলা হয় পরোক্ষ গণতন্ত্র।

গণতন্ত্রের সফলতা: গণতন্ত্রের জন্য জনগণ কর্তৃক সরকার নির্বাচনের ব্যবস্থা থাকা ছাড়াও আরো কতকগুলো কাঠামো ও আচরণগত উপাদানের উপস্থিতি প্রয়োজন। আর এ উপাদানসমূহ একটি শাসনব্যবস্থাকে জনগণের অংশগ্রহণের উপযোগী করে তোলে এবং উপযোগী রাখে। জনগণের প্রত্যক্ষ ভোটের মাধ্যমে সরকার নির্বাচিত হয় বলে গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়ায় সুফল অনেক। 

নির্বাচিত প্রতিনিধিদের জবাবদিহি করতে হয় বলে তারা স্বৈরাচারী মনোভাব পোষণ করতে পারে না। গণতন্ত্রে দেশের আপামর জনসাধারণের জীবনমান উন্নয়ন, তাদের সুযোগ-সুবিধা বৃদ্ধি ও দেশের সার্বিক সমৃদ্ধি সাধন করা যায়। রাষ্ট্রীয় নীতি নির্ধারণের ক্ষেত্রে জনসাধারণের চাহিদা অনুযায়ী পরিকল্পনা প্রণয়ন করা যায় বিধায় এটি সর্বাপেক্ষা উৎকৃষ্ট শাসনব্যবস্থা হিসেবে আধুনিক বিশ্বে নন্দিত।

গণতন্ত্রের দুর্বলতা: গণতান্ত্রিক শাসনব্যবস্থার প্রধান দুর্বলতা হলো এর যথাযথ মূল্যবোধের অভাব। একজন শিক্ষিত মানুষের মধ্যে যে ধরনের মূল্যবোধ বিদ্যমান, অশিক্ষিত লোকের মধ্যে তা নেই। কাজেই নিরক্ষর লোকের কাছে গণতন্ত্রের মূল্যায়ন ও গণতান্ত্রিক মূল্যবোধের আবেদন খুবই সীমিত। এজন্য আমাদের মতো তৃতীয় বিশ্বের দেশসমূহ যেখানে শিক্ষিতের হার খুবই কম, সেখানে গণতন্ত্র ও এর মূল্যবোধ প্রতিষ্ঠা করা দুরূহ। 

গণতান্ত্রিক মূল্যবোধ: বর্তমান বিশ্বের গণতান্ত্রিক দেশগুলোতে গণতন্ত্রের সুফল সবক্ষেত্রে সমান নয়। উন্নত বিশ্বের সাথে তৃতীয় বিশ্বের অনুন্নত দেশগুলোর গণতন্ত্রের মধ্যে বেশ পার্থক্য পরিলক্ষিত হয়। আর এর মূলে কাজ করে শিক্ষা। আবার অধিকাংশ ক্ষেত্রে তৃতীয় বিশ্বের দেশে শাসক দলের ক্ষমতার মোেহ গণতান্ত্রিক মূল্যবোধকে চরমভাবে আঘাত করে।

গণতন্ত্রে শাসকচক্র ক্ষমতার দম্ভে নিজের শাসনব্যবস্থাকে পাকাপোক্ত করতে প্রয়োজনে নির্যাতন ও অত্যাচার করতে অনেক সময় পিছপা হয় না। তারা ভুলে যায় গণতন্ত্রকে যথার্থ মর্যাদা না দিলে দেশের মঙ্গল আসতে পারে না। 

গণতন্ত্র ও বর্তমান বাংলাদেশ: ১৯৭১-এ বাঙালির সংগ্রাম, আত্মত্যাগ এবং এক নদী রক্তধারার বিনিময়ে আমরা পেয়েছি একটি পতাকা, একটি সার্বভৌম ভূখণ্ড বাংলাদেশ। বাংলাদেশ আজ আমাদের প্রাণের আবেগ, পুষ্পিত সৌরভ। অনেক কষ্টে পাওন আমাদের এই গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা। কষ্টে অর্জিত এই গণতন্ত্রকে সুষ্ঠুভাবে পরিচালিত করার ক্ষেত্রে রাজনৈতিক দলগুলে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে আসছে। জনগণের মতামতের ভিত্তিতে তারা বিভিন্ন উন্নয়নমূলক কর্মকাণ্ডে অংশ নিচ্ছে যা দেশে মানুষের জন্য কল্যাণ বয়ে আনছে। 

কেননা গণতন্ত্র হচ্ছে জনগণের শাসন ব্যবস্থা। অধিকাংশ মানুষের মতামতের ভিত্তিে সিদ্ধান্ত গ্রহণের মাধ্যমেই গঠিত হয় গণতন্ত্র। আমাদের দেশেও সুষ্ঠু গণতন্ত্র চর্চা সম্প্রসারণের মাধ্যমে দেশের মানুষের সাবি উন্নয়ন বৃদ্ধি করা সম্ভব।

উত্তরণের উপায়: বাঙালির সংগ্রামের ইতিহাস সুদীর্ঘ। এদেশের গণতন্ত্র বারবার হোঁচট খেয়েছে, পদদলিত হয়েছে। কিন্তু বীর বাঙালি মাথা নত করেনি, তার বড় প্রমাণ '৫২, '৬৯, '৭০ ও অবশেষে ১৯৭১-এ বাংলার মানুষ অধিকার আদায়ের শপথে দীপ্ত, প্রতিবাদী। কিন্তু অত্যন্ত ভালোলাগার বিষয়, ১৯৯১, ১৯৯৬ ও ২০০১, ২০০৮ ও ২০১৪- পরপর পাঁচবার গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়ায় সরকার পরিচালিত হয়েছে।

আজও আমাদের দেশে গণতন্ত্র সুষ্ঠুভাবে পরিচালিত হচ্ছে। তাই তৃতীয় বিশ্বের একটি উন্নয়নশীল দেশ হিসেবে বাংলাদেশের অর্থনীতি, বেকারত্বসহ অন্যান্য জাতীয় সমস্যার সমাধান করতে হলে গণতান্ত্রিক মূল্যবোধকে কাজে -- লাগাতে হবে। সরকারকে হতে হবে এ ব্যাপারে আরোও আন্তরিক ও আস্থাশীল।

বাংলাদেশে গণতন্ত্রের ভবিষ্যৎ: বাংলাদেশে গণতন্ত্রের ভবিষ্যত আরও মজবুত করতে হলে অগণতান্ত্রিক রাজনৈতিক দলের অশুভ তৎপরতা প্রতিরোধ করতে হবে এবং বন্ধ করতে হবে নির্বাহী কর্তৃপক্ষের অগণতান্ত্রিক পদক্ষেপ ও সামরিক বাহিনীর ক্ষমতা দখলের পথ। দলীয় স্বার্থের ঊর্ধ্বে উঠে ধর্ম-বর্ণনির্বিশেষে সকলের নাগরিক অধিকার ও সার্বিক নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে হবে। তাহলে বাংলাদেশে গণতন্ত্রের ভবিষ্যৎ আরও উজ্জ্বল ও মজবুত হতে পারে।

উপসংহার: দেশের সার্বিক উন্নয়ন, জনগণের অধিকার নিশ্চিত করতে তাদের অধিক সচেতন হতে হবে। বর্তমান বিশ্বব্যবস্থায় গণতন্ত্রের কোনো বিকল্প নেই। বাংলার মাটিতে বিরাজমান সুষ্ঠু গণতান্ত্রিক ব্যবস্থায়, মুক্তসমাজে তারুণ্যের দীপ্তিতে বুক ভরে নিঃশ্বাস নিতে চাই।

এই পোস্টটি পরিচিতদের সাথে শেয়ার করুন

পূর্বের পোস্ট দেখুন পরবর্তী পোস্ট দেখুন
এই পোস্টে এখনো কেউ মন্তব্য করে নি
মন্তব্য করতে এখানে ক্লিক করুন

SM TECHY এর নীতিমালা মেনে কমেন্ট করুন। প্রতিটি কমেন্ট রিভিউ করা হয়।

comment url